যে আনন্দ নিয়ে স্কুলে যায় শিশুরা, সেই আনন্দ নিয়ে স্কুলে যেতে পারেননি ব্যারি কেনেডি। কানাডার আদিবাসী তিনি। এখন বয়স ৬২ বছর। যখন পাঁচ বছর বয়স, তখন একটি আবাসিক স্কুলে যেতে তাঁকে বাধ্য করা হয়েছিল। এমনটা ঘটেছিল তাঁর বোনের সঙ্গেও। ব্যাপারটা এমন নয় যে তাঁর মা-বাবা ইচ্ছা করে তাঁকে ওই স্কুলে পাঠিয়েছিলেন; তৎকালীন প্রশাসন তাঁদের এমন স্কুলে যেতে বাধ্য করেছিল।
সেই সময় কানাডার আদিবাসী শিশুদের কিছু আবাসিক স্কুল চালু ছিল। আদিবাসীদের সংস্কৃতি, ভাষা, পারিবারিক ও সাম্প্রদায়িক বন্ধন মুছে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে পরিচালিত হতো শতাধিক আবাসিক স্কুল। এমন স্কুলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন উরসুলিন রেডউড (৭৯) নামের এক নারীও। তাঁদের বর্ণনায় উঠে এসেছে সেসব স্কুলের এক ভয়াবহ চিত্র।
কতটা ভয়াবহ ছিল এসব স্কুল, এর বর্ণনা উঠে এসেছে আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে। সে সময়ের পরিস্থিতি নিয়ে দেশটির আদিবাসীরা কথা বলেছেন গণমাধ্যমটির সঙ্গে। ব্যারি কেনেডি বলেছেন, তাঁর বয়স যখন আট বছর, তখন স্কুল প্রাঙ্গণে একজনকে সমাহিত করা হয়। আর সমাহিত করার এ কাজে সহযোগিতা করতে বাধ্য করা হয়েছিল তাঁকে।
এ তো গেল মৃত্যু প্রত্যক্ষ করার ধাক্কা; ব্যারি কেনেডিকে সেই সময় আরও ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তিনি বলেন, রাতে শিশুরা ঘুমিয়ে পড়ার পর তাদের পাহারা দিতে কিছু নৈশপ্রহরী নিয়োজিত থাকতেন। আর এ নৈশপ্রহরীরা তাদের ওপর চালাতেন যৌন নির্যাতন।
উরসুলিন রেডউডের অভিজ্ঞতা আরও ভয়াবহ। তিনি জানান, তাঁর সঙ্গে একই কক্ষে পাশাপাশি বিছানায় থাকতেন চাচাতো বোন জোয়ানি। তখন তাঁর বয়স ছিল ৯ থেকে ১০ বছর। সকালে একজন সন্ন্যাসী শব্দ করে সবার ঘুম ভাঙাতেন। এক সকালে জোয়ানিকে ধাক্কা দিয়েও জাগাতে পারেননি তিনি। তাঁর ধারণা ছিল, জোয়ানির হয়তো শরীর ভালো লাগছে না। এ কারণে তিনি বাথরুমে মুখ ধুতে চলে যান। এসে দেখেন, তখনো জোয়ানির ঘুম ভাঙেনি। সেদিন পড়াশোনা আর গির্জায় বিভিন্ন কাজ করার সময় উরসুলিন ভাবছিলেন, তাঁর বোন মনে হয় খুব অসুস্থ। কিন্তু পরে তিনি জানতে পারেন জোয়ানি মারা গেছেন।
কানাডায় এসব আদিবাসী স্কুলে শিশুদের রাখা হতো কড়া নজরদারিতে। চালানো হতো নানা নির্যাতন-নিপীড়ন। এমনকি অবুঝ শিশুদের অনাদরে-অযত্নে রেখে মেরে ফেলার অভিযোগ রয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। আর এসব মৃত শিশুকে কবর দেওয়া হতো স্কুল প্রাঙ্গণেই। স্বজনেরাও পেতেন না তাদের খোঁজখবর। পর্যায়ক্রমে এসব স্কুল বন্ধ হয়ে গেলেও এগুলোর মাঠ ও আশপাশে রয়েছে বিভীষিকাময় সেই নির্যাতনের ছাপ। চলতি বছর বিভিন্ন স্কুলের মাঠ ও আশপাশের এলাকায় শনাক্ত করা হয়েছে বেশ কিছু কবর। আর যাঁরা প্রাণে বেঁচে গেছেন, তাঁরা বয়ে বেড়াচ্ছেন সেই দুঃসহ স্মৃতি।
আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, কবর শনাক্তের খবর পাওয়ার পর গত সেপ্টেম্বরের মধ্যভাগে সাসকাচুয়ান প্রদেশের কু অ্যাপেল ভ্যালিতে মেরিইভাল স্কুল এলাকায় যান ব্যারি কেনেডি। তিনি যখন এই স্কুলে যান, তখন শিশুদের হাড় আর কঙ্কালে ভরা ছিল মাঠ। এ দৃশ্য দেখে কান্না ভেঙে পড়েন তিনি। এ স্কুলেই ৫ থেকে ১১ বছর বয়স পর্যন্ত পড়াশোনা করতে বাধ্য হয়েছিলেন ব্যারি। গত জুনে স্কুল থেকে কয়েক মিটার দূরত্বে ৭৫১টি কবর চিহ্নিত হয়েছে।
মেরিইভাল স্কুল কানাডার ১৩৯টি ইন্ডিয়ান রেসিডেন্সিয়াল স্কুলের একটি। স্কুলগুলোয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের দেড় লাখ শিশু পড়াশোনা করেছে। এমন স্কুল প্রথম চালু হয় ১৮৩১ সালে। পরে বিভিন্ন সময় স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। সবশেষ স্কুলটি বন্ধ হয়েছে ১৯৯৬ সালে। এসব স্কুলে মারা গেছে হাজারো আদিবাসী শিশু। কানাডার ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের (টিআরসি) হিসাব অনুযায়ী, নিহত শিক্ষার্থীর সংখ্যা চার থেকে ছয় হাজার।
এসব স্কুলে থাকাকালে যেসব শিশু মারা গেছে, তাদের কবর চিহ্নিত করতে ১৫ লাখ মার্কিন ডলার চেয়েছিল টিআরসি। ঘটনাটি ২০০৯ সালে। কিন্তু সে সময় কানাডা সরকার সেই তহবিল দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। এরপর আদাবাসীরা নিজেরা তহবিল সংগ্রহ করে এবং বিশেষজ্ঞ দল ভাড়া করে। এরপর ভূগর্ভস্থ রাডার ব্যবহার করে এসব কবরের সন্ধান করা হয়। মে মাসের শেষের দিকে ফার্স্ট নেশনের অন্তর্গত একটি আদিবাসী গোষ্ঠী প্রথম ঘোষণা করে, ২১৫টি শিশুর দেহাবশেষ উদ্ধার করেছে তারা। ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার কামলুপস ইন্ডিয়ান রেসিডেন্সিয়াল স্কুলের মাঠে তাদের সমাহিত করা হয়েছিল। এরপর আরও কয়েকটি আবাসিক স্কুলের কাছের এলাকা থেকে শিশুদের দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয়।
কীভাবে এসব শিশুকে স্কুলে নেওয়া হতো, এর একটি বর্ণনা দিয়েছেন ব্যারি। তিনি বলেন, মা-বাবা আর সাত ভাইবোনের সঙ্গে বাড়িতেই ছিলেন তিনি। প্রথমে তিনি তাঁর বাবার চিৎকার শুনতে পান। এরপর দরজার দিকে তাকিয়ে দেখেন, কয়েকজন ব্যক্তি সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁরা হলেন কানাডীয় সরকারের একজন প্রতিনিধি, এক পুলিশ কর্মকর্তা, এক ধর্মযাজক ও আবাসিক স্কুলের কয়েকজন প্রতিনিধি।
ব্যারির মা তখন সন্তানদের জড়ো করে শয়নকক্ষের দিকে নিয়ে যান এবং তাদের সেখান থেকে বের হতে নিষেধ করেন। এরপর সেই ব্যক্তিদের সঙ্গে ব্যারির মা-বাবার বাদানুবাদ হয়। ভেতর থেকে চিৎকার আর কান্নার শব্দ শোনেন ব্যারি। ওই ব্যক্তিদের হাত থেকে সন্তানদের বাঁচাতে চাইছিলেন মা-বাবা। তবে শেষ রক্ষা হয়নি।
ব্যারি বলেন, তাঁর মা-বাবাও এসব আবাসিক স্কুলে পড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। সেখানে থাকাটা কতটা যন্ত্রণার, সেটা বুঝতেন তাঁরা। তাই তাঁরা চাইছিলেন না সন্তানেরাও একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হোক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সন্তানদের এসব স্কুলে পাঠানো ছাড়া তাঁদের আর উপায়ও ছিল না। তা না হলে তাঁদের জেলে যেতে হতো। ব্যারি বলেন, সেদিন তিনি ও তাঁর তিন বোনকে গাড়িতে করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।
শুরুতে গির্জার মতো একটি ভবনের সামনে গাড়ি থামিয়ে বোনদের ওই ভবনের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেটি ছিল মেয়েদের আবাসিক ভবন। এরপর ব্যারিকে নেওয়া হয় ছেলেদের আবাসিক ভবনে। এক ধর্মযাজক তাঁকে গাড়ি থেকে নামিয়ে ভেতরে নিয়ে যান। ভয় পেয়ে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন ব্যারি, তবে সফল হননি।
এরপর ব্যারির মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হয়। মাথা থেকে পা পর্যন্ত কালো পোশাকে ঢাকা এক নারী তাঁকে ঠান্ডা পানিতে গোসল করতে বাধ্য করেন। এরপর তোশক আর কিছু কাপড় দিয়ে তাঁকে কক্ষে পাঠানো হয়। এসব কক্ষেই রাতে নিরাপত্তাপ্রহরীর হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হতো শিশুরা।
ব্যারি জানান, ভয়াবহ সেই স্কুলজীবন শেষ হওয়ার পরও মানসিক যন্ত্রণা কাটাতে পারছিলেন না। একটা সময় তিনি মদ পান শুরু করেছিলেন। তবে তাঁর মা ও সৎবাবার সহযোগিতায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সক্ষম হন তিনি। বর্তমানে নয় সন্তানের জনক এ ব্যক্তি। ক্যারি দ্য কেটল ফার্স্ট নেশনের প্রধান হিসেবেও দুবার দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
মেরিইভাল আবাসিক স্কুলে নিপীড়নের ঘটনার আরেক সাক্ষী উরসুলিন রেডউড। শৈশবে তাঁকেও আবাসিক স্কুলে নেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘নিজেকে এক জীবন্ত লাশ মনে হতো। তারা যা করতে বলত, সেটাই করতে হতো।’
উরসুলিন বলেন, তাঁর সেই চাচাতো বোনের কী হয়েছিল, তা কখনোই উরসুলিনকে জানানো হয়নি। যতটুকু মনে পড়ে, মৃত্যুর কয়েক দিন আগে থেকে জোয়ানির কাশি হচ্ছিল। উরসুলিনের ধারণা, তাঁর বোনের যক্ষ্মা হয়েছিল। সন্ন্যাসীরা কখনোই চিকিৎসার ব্যবস্থা করেননি। জোয়ানির মৃতদেহ কী করা হয়েছে, তাও জানেন না উরুসুলিন। মেরিইভাল স্কুল এলাকায় শনাক্ত হওয়া কবর দেখিয়ে তিনি বলেন, এখানেই কোথাও হয়তো জোয়ানিকে সমাহিত করা হয়েছে।